বিষ্ণুপুরের ইতিহাস কে এই লাল বাই? বিষ্ণুপুরে তার কি সম্পর্ক?
বিষ্ণুপুর ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়-এর নাম যদি 'লালবাঈ',হয়, তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসবে কে এই লালবাঈ, আর বিষ্ণুপুরের ইতিহাসে কেনই বা সে কলঙ্কিতা? বিষ্ণুপুরের রাজ কাহিনী পুংখানুপুংখরূপে অনুধাবন করলে দেখা যায় যে সে দুর্ধর্ষ পাঠান রহিম খাঁ'র সঙ্গীত নিপুণা রূপসী লাস্যময়ী বেগমসাহেবা। এখন প্রশ্ন বিষ্ণুপুরের ইতিহাসে তার অনুপ্রবেশ ঘটল কীভাবে? আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই ইতিহাস। শোভাসিংহ ও রহিম খাঁর যৌথ আক্রমণে বিষ্ণুপুর যখন আক্রান্ত তখন অনেকেই ভেবেছিলেন বিষ্ণুপুরের পরাজয় শুধু সময়ের অপেক্ষা কিন্তু মহারাজ রঘুনাথ সিংহদেব সকলকে ভুল প্রমাণ করে তাঁর রণনিপুণতায় চেৎবরদা জয় করে তাকে পরিণত করেন ধ্বংসস্তুপে,তখন সেখান থেকে ফেরার সময় রহিম খাঁ'র শিবির লুণ্ঠন করা ধনরত্নের সঙ্গে রাজাকে সন্তুষ্ট করার জন্য উপহার হিসাবে তাঁর সৈন্যরা নিয়ে আসে রহিম খাঁ'র সঙ্গীত নিপুণা রূপসী বেগম লালবাঈকে। ঘনিভূত হয় অসন্তোষের কালো ছায়া। সরলপ্রাণ উদারচেতা রাজা তাঁকে আশ্রয় দেন প্রথমে লালগড় নামক স্থানে ও পরে তার জন্য নির্মিত করা, 'নতুনমহল' বাসভবনে। সেদিনই লোকচক্ষুর অন্তরালে বিষ্ণুপুরের বুকে রোপিত হয় তার সর্বনাশের বিষবৃক্ষ। সঙ্গীত প্রিয় রাজা গান শোনার জন্য মাঝে মাঝে যান লালবাঈয়ের নতুনমহল বাসভবনে।
লালবাঈয়ের মোহ-মদির রূপ ও মনমাতানো সঙ্গীত ক্রমশঃ রাজাকে গ্রাস করে ফেলে। বিষ্ণুপুরের বুকে ঘনিয়ে আসে তিমির ঘন রাত্রি। আশঙ্কিত হয়ে উঠেন সকলেই যে কী করে রাজাকে ওই মোহাবর্ত থেকে উদ্ধার করা যায়। ক্রমে ক্রমে এতো সদ্ গুণের আকর রঘুনাথ সিংহদেব পরিণত হয়ে পড়েন এক দুশ্চরিত্রা নারীর যন্ত্রপুত্তলিকায়।শুরু হয় রাজাকে নিয়ে তার খেয়ালি খেলা। তার প্ররোচনায় রাজা খনন করেন বিষ্ণুপুরের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে এক বিশাল দীঘি,নাম দেন লালবাঁধ।অনেকে মনে করেন উক্ত বাঁধ খোঁড়ার পর জল লাল হওয়ার তার নাম লালবাঁধ।যুক্তির দিক দিয়ে যার কোনো ভিত্তি নেই। দীঘি-বাঁধ-পুকুর যাই খোঁড়া হোক না প্রথমে তার জল লালই হয়। স্বভাবতই তা না হয়ে লালবাঈয়ের নামেই যে তার নাম লালবাঁধ হয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
প্রবাদ আছে লালবাঁধের দক্ষিণ-পূর্ব তীরে যে গড় আছে যেখানে লালবাঈকে প্রথমে রাখা হয় লালবাঈয়ের নামেই তার নাম রাখা হয় লালগড়।এমনি করে স্বেচ্ছাচার অনাচারে ধূমায়িত রোষ পরিণত হয় বিদ্রোহে। বিষ্ণুপুরের প্রজারা রঘুনাথসিংহদেব অপুত্রক থাকায় তার ভ্রাতা গোপালসিংহদেবকে রাজা করতে মরিয়া কিন্তু দাদার বিরুদ্ধাচরণ করতে তিনি সম্মত নন। এদিকে শয়তানী লালবাঈ এমন অবস্থার সৃষ্টি করেন যার জন্য গোপালসিংদেবকে আত্মগোপন করতে হয়। কিন্তু কথায় বলে লোভে পাপ,পাপে মৃত্যু। এক সময় লালবাঈয়ের গর্ভে এক পুত্রসন্তান হয় আর সেই সন্তানকে উপলক্ষ্য করেই নেমে আসে বিধাতার অভিশাপ। রচিত হয় তার শেষ সজ্জা।সন্তানকে উপলক্ষ্য করে তার যে বাসনা জেগে উঠে প্রজাগণের কাছে তা ছিল অত্যন্ত ক্রুর।হিন্দুর সন্তান সন্ততি হলে যেমন অন্নপ্রাশন ইত্যাদি হয় শয়তানির মনেও জাগলো তদ্রুপ বাসনা।শুরু হয় সেইমতো আয়োজন।আর সেই উপলক্ষ্যে তার বাবুর্চির পাক করা খাবার নগরের সমস্ত প্রজাদের একসঙ্গে খাওয়াতে চায় সে। রাজা অসম্মত হলেও ছন্নমতি নারী কিছুতেই তার সংকল্প ত্যাগ করতে সম্মত হয় না। প্রজাদের খাওয়ানোর জন্য বিশাল জায়গা পরিষ্কার করা হয় এখনো সেই জায়গা 'ভোজনটিলা' নামে অভিহিত। নতুনমহল শ্মশান কালী মন্দির যাওয়ার রাস্তায় যেটি পড়ে। তারপর দিন স্থির করা হয়। এদিকে সেই আদেশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তেই প্রজাগণ প্রমাদ গুনেন। রাজ্যের এ হেন দুর্দিনে এগিয়ে আসেন মহারাণী চন্দ্রপ্রভা।তেজমাধুর্যময়ী নারী সর্বস্ব পণ করে অগ্রসর হন তার গতিরোধ করতে।রাজকর্মচারীদের আদেশ দেন ছলে-বলে-কৌশলে রাজধর্ম রক্ষা করতে হবে। সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।মহারাণীর জয়গানে ভরে উঠে রাজ্য। অন্যদিকে লালবাঈয়ের কাছে সেই সংবাদ পৌঁছাতেই দলিতা সাপিনীর মতো রুদ্ধ আক্রোশে গর্জাতে থাকে। গর্জে উঠেন রঘুনাথ সিংহদেবও। তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করাতে তলব করেন নতুনমহল বাসভবনে।কিন্তু কেউ তাঁর আদেশ পালন করে না।সেই ধৃষ্টতার শাস্তি দেবার জন্য ফিরে যান রাজদরবারে।মহারাণীর নির্দেশমতো কেউ তাঁর সম্মুখে আসে না। মহারাণীর সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য যান রাজ অন্তপুরে ।মহারাণী তখন হাওয়ামহলের উপরে। কোন সাহসে সে এরূপ কাজ করেছে জানতে চাইলে মহারাণীও নির্ভীক। দৃঢ় কণ্ঠে রাজাকে তার সর্বনাশী আদেশ প্রত্যাহার করতে অনুরোধ জানান। চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী। রাজা তার সিদ্ধান্তে অবিচল। বেজে উঠলো ধর্মের বিজয় ভেরী। ধর্মকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য অনন্যোপায় রাণী বেদনার নিষ্ঠুর পথই বেছে নিলেন
।ইঙ্গিতে রাজ কর্মচারীদের নির্দেশ দেন শেষ উপায় অবলম্বনের জন্য। আততায়ীর হাতে আহত হয়ে পলায়ন করতে গিয়ে ঝাঁপ দিলেন নীচে থাকা হরিণপিঞ্জরে। পড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মারা যান রঘুনাথ সিংহদেব। রাজ্যে ফিরে আসে স্বস্তির নিঃশ্বাস।সকলের বুক থেকে পাষাণভার নেমে যাওয়ার পরই নেমে আসে হাহাকার।সকলের অনুনয় অনুরোধ উপেক্ষা করে মহারাণী ঝাঁপ দেন স্বামীর জ্বলন্ত চিতায়। 'পতীঘাতিনী সতী' রূপে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে তাঁর খ্যাতি। বিষ্ণুপুর উত্তাল।শোকে দুঃখে প্রজাগণ হয়ে উঠেন পাগলের মতো।সব অনর্থের মূল লালবাঈ,তাই প্রচণ্ড ক্রোধে তার বাসভবনকে ভেঙ্গেচুরে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয় তারা। নির্মমভাবে ডুবিয়ে মারে লালবাঈকে তার নতুনমহল সংলগ্ন চৌবাচ্চায়।কেহ বলেন প্রজা কর্তৃক লাঞ্ছিতা হওয়ার আশঙ্কায় উক্ত জলাশয়ে আত্মহত্যা করে লালবাঈ।১৮৯৮ খৃষ্টাব্দে জলাশয় পরিষ্কার করে তাকে ব্যবহারের উপযুক্ত করা হয়।তখন ওখানে লালবাঈয়ের কঙ্কাল ও বহু মুসলমানি খাদ্য পাত্র পাওয়া যায়। শেষ হয় বিষ্ণুপুর ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়।
সূত্র-ফকিরনারায়ণ কর্মকার রচিত 'বিষ্ণুপুরের অমর কাহিনী'।
বিষ্ণুপুরে কী জহর প্রথা প্রচলিত ছিল সেই সময়? মহারানি চন্দ্রপ্রভা দেবী স্বামী হত্যার অন্যতম কারণ বলে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় প্রাণ বিসর্জন দেন। লালবাঈ যে সন্তানের জন্ম দিয়েছিল সে বিষয়ে যদি আলোকপাত করলে ভালো হয়। মহারাণি চন্দ্রপ্রভা দেবী কী নিঃসন্তান ছিলেন নাকি তাঁর কন্যাসন্তান ছিল যার বিবাহ দেওয়া হয়েছিল লালবাঈ'র আগমনের পূর্বে? এবিষয়ে আলোচনা করলে বিষয় টি পরিস্কারভাবে জানা যেতো।
ReplyDelete